বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক সমস্যা মোকাবেলা করেন। এক্ষেত্রে আগে প্রধানতম বাধাগুলোর মধ্যে প্রথমেই দুর্নীতিকে চিহ্নিত করতেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে তারা প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছেন আমলাতন্ত্রের অদক্ষতাকে।
বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া এ মতামত তুলে ধরেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) নিয়মিত বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট’ (জিসিআর) প্রকাশকালে গতকাল এ মতামত তুলে ধরা হয়। তবে এ সময় আরো জানানো হয়েছে, এদিকে চলমান কভিড-১৯ মহামারীর কারণে দেশের বড় ব্যবসাগুলো আরো বড় হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
এবার করোনার কারণে অন্যান্য বছরের মতো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকের র্যাংকিং প্রকাশ করা হয়নি। তবে কোন দেশের কী সমস্যা তা জানতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতামতভিত্তিক একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। ডব্লিউইএফের পক্ষে বাংলাদেশে কাজটি করেছে সিপিডি। ১০ কোটি টাকার ওপর সম্পদ আছে, এমন ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের মতামতের ভিত্তিতে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
সে হিসেবে গতকাল প্রকাশিত ‘হাউ কান্ট্রিজ আর পারফর্মিং অন দ্য রোড টু রিকভারি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিকে ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনের বিশেষ সংস্করণ বলা চলে। প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের করোনার প্রভাব কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের পথে অগ্রযাত্রার পর্যালোচনা করা হয়। প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এখানে ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
সিপিডির উপস্থাপনা অনুযায়ী, উদ্যোক্তারা ব্যবসা করতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন, তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে অদক্ষ আমলাতন্ত্র। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭২ শতাংশই এ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে দুর্নীতি। জরিপে অংশ নেয়া ৬৮ শতাংশ এ সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সীমিত অর্থায়ন সুবিধার কথা। ৬৬ শতাংশ উত্তরদাতা এ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
উপস্থাপনায় আরো জানানো হয়, এ সীমিত অর্থায়ন সুবিধার বিষয়টি ক্রমেই আরো উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এটি বড় একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের গত বছর মোকাবেলা করা সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে অপ্রতুল অবকাঠামো। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে শিক্ষিত শ্রমিকের অপর্যাপ্ততার কথাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ সমস্যার বিষয়ে জানিয়েছেন ৩৪ শতাংশ উত্তরদাতা। শ্রমিকের কাজের নৈতিকতার মতো সমস্যার কথা জানিয়েছেন ৩২ শতাংশ। উপস্থাপনায় ব্যবসায়ীদের জানানো প্রধান সমস্যা হিসেবে শীর্ষ ১৬টির বিষয়ে উল্লেখ করেছে সিপিডি।
প্রতিবেদন নিয়ে উপস্থাপনায় সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছে একেক সময় একেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। একসময় দুর্নীতি ছিল বড় সমস্যা। পরে অবকাঠামো বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন আবার ব্যবসায়ীরা অদক্ষ প্রশাসনকে বড় সমস্যা মনে করছেন। ব্যবসার ঝুঁকির ক্ষেত্রে ধারণাগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীরা এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। এ মানসিকতা ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রক্ষেপণে ব্যবসায়ীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাত নিয়ে ধারণার অবনমন হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ৭৫ শতাংশ উদ্যোক্তা ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ৭৩ শতাংশ জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো যে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করছে, তা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
উপস্থাপনায় আরো জানানো হয়, ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার আরো দুর্বল হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের দুর্বল নজরদারির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরো প্রতিযোগিতাসক্ষম করতে ১২টি বিষয়ের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সুশাসন, অবকাঠামো, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ, অর্থায়নের পরিবেশ, বৈদেশিক বাণিজ্য, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, ব্যবসা পরিচালনা, নিরাপত্তা, ঝুঁকি ইত্যাদি।
প্রতিবেদন সম্পর্কে উপস্থাপনার সমাপনীতে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, সুশাসনের জায়গাটি পরিবর্তন করতে গেলে আরো অনেক বেশি উন্নয়নের প্রয়োজন পড়বে। আমরা দেখেছি, সরকারি বিনিয়োগ বেসরকারি বিনিয়োগকে যতটা আকৃষ্ট করার কথা ছিল, ততটা আকর্ষণ করছে না। কীভাবে ব্যয় কমিয়ে সাশ্রয়ী প্রকল্প করা যায়, সে বিষয়েও নজর দিতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইড কমিয়ে আনতে হবে। মানবসম্পদকে ডিজিটাল মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। আর্থিক খাতের ইতিবাচক প্রভাব এসএমইর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে নতুন মডেল ভাবতে হবে।
প্রতিবেদন প্রকাশকালে ভবিষ্যৎ রূপান্তরের জন্য চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে সিপিডি। এগুলো হলো ব্যবসার পরিবেশ রূপান্তর, মানবসম্পদ রূপান্তর, বাজার রূপান্তর ও উদ্ভাবনমুখী রূপান্তর।
প্রতিবেদন প্রকাশকালে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সুদৃঢ় করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে গিয়ে যেন কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি না হয়। দক্ষ প্রশাসন তৈরি করতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দক্ষ ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করার পরিবেশ সহজ করতে হবে। প্রযুক্তির উত্কর্ষ বাড়াতে হবে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা ধরনের রূপান্তর প্রয়োজন।